মুন্সীগঞ্জের কায়াতখালী গ্রাম—একটি সাধারণ গ্রামীণ সমাজ। মানুষ ভোরে মাঠে যায়, দুপুরে হাটে, সন্ধ্যায় আড্ডায় বসে। স্কুলের শিশুদের ভিড়, মসজিদের আযান, মেলায় মানুষের ভিড়—সব মিলিয়ে এটি একটি জীবন্ত গ্রাম। কিন্তু সম্প্রতি এই গ্রামে মৌলবাদীদের এক বিপজ্জনক ছায়া নেমে এসেছে।
হিজবুত তাহরিরের অনুসারী কয়েকজন ব্যক্তি গ্রামে প্রচার করছে—
মেয়েরা নাকি বেশি পড়াশোনা করতে পারবে না,
পুরুষদের নাকি চারটি বিয়ে করতেই হবে,
গান, বাজনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব নাকি হারাম।
প্রশ্ন হলো—এই দাবিগুলো কি ইসলাম সম্মত? এই দাবিগুলো কি আমাদের সমাজের জন্য মঙ্গলজনক? নাকি এগুলো আসলে অজ্ঞতা, নারীবিদ্বেষ আর বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র?
—
মেয়েদের শিক্ষার বিরুদ্ধে ফতোয়া: অর্ধেক জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া
কায়াতখালীর সরকারি প্রাথমিক স্কুলে এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের উপস্থিতি বেশি। গ্রামের গৃহবধূরা আজ মেয়েদের কলেজে পাঠাচ্ছেন, অনেকেই চান মেয়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হোক। অথচ মৌলবাদীরা মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে—“মেয়েদের বেশি পড়াশোনা হারাম, তারা ঘরে থাকবে।”
একজন কৃষক বাবা বলেন:
> “আমার মেয়ে SSC দিয়েছে। ও ভালো পড়াশোনা করে। আমি চাই সে ডাক্তার হোক। এখন যদি মৌলবাদীরা বলে পড়াশোনা হারাম, তাহলে আমি কীভাবে মেয়ের স্বপ্ন ভাঙব?”
শিক্ষাবঞ্চিত মেয়ে মানেই শিক্ষাবঞ্চিত পরিবার। তাই মেয়েদের শিক্ষার পথে বাঁধা দেওয়া মানে একটি গোটা প্রজন্মকে অশিক্ষিত রেখে দেওয়া।
—
চার বিয়ে বাধ্যতামূলক—ধর্মের অপব্যাখ্যা
ইসলাম চার বিয়ের অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু শর্ত দিয়েছে কঠোর ন্যায়বিচারের। কুরআনে স্পষ্ট বলা আছে—যদি ন্যায়বিচার করতে না পারো, তবে একটিই যথেষ্ট। কিন্তু হিজবুত তাহরিরের এই মৌলবাদীরা বলছে—প্রত্যেক পুরুষকেই নাকি চার বিয়ে করতেই হবে!
বাস্তবতা কী?
গ্রামের হাটে একজন চাষি বলেন:
> “একটা সংসারই চালানো কষ্ট। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, ঘরের খরচ—সবই চাপ। এখন আবার চার বিয়ে বাধ্যতামূলক করলে সমাজে ঝগড়া-বিবাদ ছাড়া আর কী হবে?”
এই ফতোয়া শুধু নারীর অধিকার কেড়ে নেয় না, বরং সমাজে অশান্তি ছড়ায়।
—
গান-বাজনা বন্ধ: গ্রামের প্রাণ শুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
কায়াতখালীর বৈশাখী মেলা মানেই বাউল গান, ঢোলের বাজনা, শিশুর হাসি। বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই মাইকে গানের সুর। এটাই গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রাণ।
কিন্তু মৌলবাদীরা বলছে এগুলো হারাম। তারা চায় মানুষ যেন গান না শোনে, কবিতা না পড়ে, নাচ-নাটক না করে। কারণ তারা জানে—সংস্কৃতি মানুষকে মুক্তমনা করে তোলে, সংস্কৃতি মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়।
একজন গ্রামীণ নারী বলেন:
> “বছরে একবার মেলা হয়, সেখানে গিয়ে গান শোনা আমাদের আনন্দ। এখন যদি বলে গান বাজনা বন্ধ, তবে আমাদের বেঁচে থাকার আনন্দটাই বন্ধ হয়ে যাবে।”
—
মৌলবাদীরা আসলে কী চায়?
তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো—
1. মানুষকে ভয় দেখানো,
2. মেয়েদের ঘরে বন্দি রাখা,
3. সমাজকে অজ্ঞ রাখার মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করা।
তারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের তালেবানি অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়।
—
প্রতিরোধের পথ: কায়াতখালীর মানুষকে জেগে উঠতে হবে
এই মৌলবাদীদের থামানো সম্ভব—যদি গ্রামবাসী একসাথে দাঁড়ায়।
শিক্ষকরা খোলাখুলি ঘোষণা করবেন: “মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করা যাবে না।”
ইমামরা প্রচার করবেন—ইসলামে জ্ঞান অর্জন নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ফরজ।
তরুণরা খেলাধুলা, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাড়িয়ে মৌলবাদীদের ভ্রান্তি ভাঙবে।
মহিলারা সংগঠিত হয়ে তাদের অধিকার নিয়ে সরব হবেন।
প্রশাসন কঠোরভাবে এই ধরনের উগ্রবাদী তৎপরতা দমন করবে।
—
উপসংহার
কায়াতখালীর হিজবুত তাহরির মৌলবাদীরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতাকে বন্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে—বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জন্ম নেওয়া দেশ। এখানে মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ হবে না, পুরুষদের চার বিয়ে বাধ্যতামূলক হবে না, গান-বাজনা থামবে না।
আমরা স্পষ্টভাবে বলি—
বাংলাদেশ অন্ধকারের নয়, বাংলাদেশের পরিচয় আলোর।
কায়াতখালীর মানুষ মৌলবাদীদের রুখে দাঁড়াবে।
নারীর শিক্ষা, সংস্কৃতি আর স্বাধীনতাই হবে আমাদের আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।