Thu. Sep 11th, 2025

বাংলাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো বারবার সমাজের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জে হিজবুত তাহরির নামক জঙ্গী সংগঠন মেয়েদের নাচ-গানসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে। এই বক্তব্য শুধু একটি মতামত নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক পরিকল্পনার অংশ, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

১. নারী ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বয়ান

হিজবুত তাহরির নারীদের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চাকে “অনৈতিক” আখ্যা দেয়। তাদের যুক্তি হলো ধর্মীয় শাসনব্যবস্থার আওতায় নারীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপস্থিতি সীমিত থাকতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই ব্যাখ্যার উৎস কী? মূলত তারা ইসলামকে ব্যবহার করছে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে। ইতিহাস ও গবেষণা বলছে, ইসলামিক সভ্যতার স্বর্ণযুগে নারী সাহিত্য, সংগীত ও দর্শনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। সুতরাং হিজবুত তাহরিরের অবস্থান ধর্মীয় নয়, বরং রাজনৈতিক।

২. সাংস্কৃতিক দমন মানেই সামাজিক পশ্চাৎগতি

যে কোনো সমাজের অগ্রগতি নির্ভর করে তার সংস্কৃতির বিকাশের ওপর। নাচ, গান, নাটক, চিত্রকলা—এসব মানুষের সৃজনশীলতাকে বিকশিত করে এবং জাতির চেতনায় প্রাণসঞ্চার করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সংস্কৃতি ছিল অন্যতম প্রেরণা। এখন যদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়, তবে তা সরাসরি জাতির মানসিক বিকাশকে রুদ্ধ করবে। হিজবুত তাহরিরের বক্তব্য তাই কেবল নারীর স্বাধীনতার ওপর আঘাত নয়, বরং সামগ্রিকভাবে জাতীয় অগ্রগতির ওপর আঘাত।

৩. রাজনৈতিক লক্ষ্য: রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান

হিজবুত তাহরিরকে কেবল একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী মনে করা ভুল হবে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জঙ্গী নেটওয়ার্কের অংশ, যারা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে “খিলাফত” কায়েম করতে চায়। বাংলাদেশের সাংবিধানিক গণতন্ত্র, নারীর অধিকার, সংস্কৃতি—এসবই তাদের কাছে শত্রু। তাই তারা বারবার এমন ইস্যু উত্থাপন করে, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসন্তোষ উসকে দেয়।

৪. সামাজিক প্রতিরোধ জরুরি

হিজবুত তাহরিরের মতো গোষ্ঠীর মোকাবিলা কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব নয়। সমাজকেও সচেতন হতে হবে। অভিভাবকদের বোঝাতে হবে যে মেয়েদের শিল্পচর্চা কোনো অপরাধ নয়; বরং এটি আত্মবিশ্বাস ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে। শিক্ষাঙ্গনে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে আরও জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি গণমাধ্যমকে মৌলবাদী প্রচারণার বিরুদ্ধে যুক্তিনির্ভর প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে।

৫. রাষ্ট্রের করণীয়

বাংলাদেশের সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে। তাই মৌলবাদীরা যখন নারীর সাংস্কৃতিক অধিকার অস্বীকার করে, তখন তারা সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন করে। রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে। শুধু নিষিদ্ধ ঘোষণা নয়, বরং এদের মতাদর্শের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।

উপসংহার

হিজবুত তাহরির ও অনুরূপ মৌলবাদী সংগঠনগুলোর লক্ষ্য স্পষ্ট—বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়া, নারীকে বন্দি রাখা এবং সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা। আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো এদের বয়ানকে শুধু খণ্ডন নয়, বরং বিশ্লেষণ করে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করা যে—সংস্কৃতি ও নারী মুক্তিই হলো অগ্রগতির চালিকা শক্তি। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে মৌলবাদী অন্ধকার নয়, আলোকিত যুক্তিবাদী চেতনার পথেই হাঁটতে হবে।