মুন্সিগঞ্জের কায়ালখালীর এক সভায় হিজবুত তাওহীদ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে—মেয়েরা নাকি “বেশি দূর” পড়াশোনা করতে পারবে না। এই বক্তব্য শুধু অযৌক্তিকই নয়, এটি রাষ্ট্রবিরোধী ও অসাংবিধানিকও বটে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—“রাষ্ট্র জনগণের জন্য বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করবে এবং যথাসম্ভব একক ও সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।” আর ১৯(৩) অনুচ্ছেদে পরিষ্কার উল্লেখ আছে—“নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র।” তাহলে প্রশ্ন হলো, সংবিধানের চোখে সমান অধিকারপ্রাপ্ত মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করার ক্ষমতা এদের কে দিল?
নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে মৌলবাদী ষড়যন্ত্রের ইতিহাস
এ ঘটনা নতুন নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর আগে বারবার মৌলবাদীরা নারীর চলাফেরা, কর্মক্ষেত্রে যাওয়া, এমনকি পোশাক নিয়েও ফতোয়া দিয়েছে। ১৯৯৩ সালে টাঙ্গাইলে নারী উন্নয়ন কর্মীদের ওপর হামলা হয়েছিল শুধুমাত্র তারা গ্রামে গিয়ে নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করার কারণে। ২০১০ সালে হাইকোর্ট স্পষ্ট করে রায় দিয়েছিল—কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ফতোয়া জারি করার অধিকার নেই। তবু মৌলবাদীরা বারবার এই বেআইনি কাজ করে যাচ্ছে, কারণ সমাজে প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে আছে।
নারীশিক্ষা মানেই জাতির শক্তি
বাংলাদেশের অগ্রগতি মূলত নারীশিক্ষার সাফল্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। UNESCO-র সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের ভর্তি হার ৯৮ শতাংশেরও বেশি। মাধ্যমিকে মেয়েদের ভর্তি হার ছেলেদের চেয়েও বেশি (২০২৩ সালে মাধ্যমিকে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল প্রায় ৫৫%)। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। আজ বাংলাদেশে হাজার হাজার নারী চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও শিক্ষক সমাজকে আলোকিত করছেন।
একটি নারীকে শিক্ষিত করা মানে পুরো পরিবারকে শিক্ষিত করা। UNICEF-এর গবেষণা বলছে, একজন মা শিক্ষিত হলে তার সন্তানের স্কুলে যাওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ হয়। অর্থাৎ নারীশিক্ষা শুধু নারীকে শক্তিশালী করে না—এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও শক্তিশালী করে।
মৌলবাদীরা কেন ভীত?
মৌলবাদীরা জানে, শিক্ষিত নারী অন্ধকারে বসে থাকবে না। তারা প্রশ্ন করবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, সামাজিক পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেবে। তাই মৌলবাদীরা শিক্ষাকে শত্রু হিসেবে দেখে। তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বন্দি করে রাখতে চায়, কিন্তু শিক্ষিত নারী সেই ফাঁদ ভেঙে দেয়। এ কারণেই তারা নারীশিক্ষাকে থামাতে চায়।
নীরবতা মানে সমর্থন
আমরা যদি আজ চুপ থাকি, কাল হয়তো মৌলবাদীরা বলবে মেয়েরা অফিসে যেতে পারবে না, ভোট দিতে পারবে না, এমনকি ঘর থেকেও বের হতে পারবে না। পাকিস্তানের তালেবানদের মতোই বাংলাদেশকেও তারা অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়। আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিই প্রমাণ করে—নারীশিক্ষা বন্ধ হলে একটি জাতি কীভাবে পশ্চাদপদ হয়ে পড়ে।
এখনই করণীয়
১. প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা: সংবিধানবিরোধী এই ফতোয়া দাতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
২. শিক্ষা আন্দোলন জোরদার করা: প্রত্যন্ত গ্রামেও মেয়েদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে সরকার ও সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
৩. সচেতনতা বৃদ্ধি: শিক্ষক, অভিভাবক, গণমাধ্যম—সবাইকে নারীশিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠ তুলতে হবে।
৪. ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ: মৌলবাদবিরোধী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করা জরুরি।
শেষ কথা
মুন্সিগঞ্জের কায়ালখালীর ফতোয়া কেবল একটি গ্রাম বা জেলার সমস্যা নয়—এটি গোটা বাংলাদেশের অগ্রগতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। নারীর পথ রুদ্ধ করার মানে জাতির পথ রুদ্ধ করা। তাই আজই আমাদের বলতে হবে—
নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে কোনো ফতোয়া মানি না, মানব না।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নারীর হাতে সমানভাবে গড়ে উঠবে।
নারীশিক্ষাকে রক্ষা করা মানেই বাংলাদেশকে রক্ষা করা। আর মৌলবাদীদের স্থান কেবল ইতিহাসের অন্ধকারে।