Thu. Sep 11th, 2025

মুন্সীগঞ্জের কায়াতখালিতে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলো সম্প্রতি নাচ-গান ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা বলছে—এসব “অশ্লীল”, “ধর্মবিরোধী” এবং সমাজে নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করে। অথচ বাস্তবে নাচ-গান শুধু বিনোদন নয়; এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও সামাজিক অগ্রগতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। তাহলে কেন এরা নাচ-গানের বিরুদ্ধে? এর ভেতরে আসলে কী উদ্দেশ্য কাজ করছে?

১. সংস্কৃতি দমনের মাধ্যমে সমাজ নিয়ন্ত্রণ

সংস্কৃতি হলো মানুষের আনন্দ, ঐক্য ও সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। গান, নাচ, নাটক বা কবিতা মানুষকে মুক্তভাবে ভাবতে শেখায়, অন্ধ আনুগত্য থেকে দূরে রাখে। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলো ঠিক এখানেই সমস্যায় পড়ে। কারণ তারা এমন এক সমাজ চায় যেখানে প্রশ্ন নেই, যুক্তি নেই, কেবল অন্ধ বিশ্বাস ও ভয় আছে।

👉 তাই নাচ-গানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তাদের কাছে কেবল ধর্মীয় নয়; বরং এটি সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল।

২. নারীর প্রকাশ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

নাচ-গান মানেই সেখানে নারীর সক্রিয় উপস্থিতি। নারী কণ্ঠ, দেহভঙ্গি, শিল্পচর্চা—এসবই আসলে নারীর আত্মপ্রকাশ। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী নারীর এই প্রকাশকে ভয় পায়। কারণ তারা চায় নারীরা কেবল গৃহকেন্দ্রিক থাকুক, যেন তাদের শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র বা সামাজিক নেতৃত্বে কোনো ভূমিকা না থাকে।

👉 কায়াতখালিতে নাচ-গানের ওপর আপত্তি আসলে নারীর কণ্ঠ ও প্রতিভাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা।

৩. ধর্মের অপব্যাখ্যা

ইসলামের ইতিহাসেই আমরা দেখি সংগীত, সাহিত্য ও নাটকের চর্চা। সুফি সাধকেরা গানকে আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মধ্যযুগে মুসলিম সভ্যতায় সংগীত, কবিতা, স্থাপত্য, চিত্রকলা—সবই সমৃদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু কায়াতখালির ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ধর্মের মূল চেতনাকে বিকৃত করে মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়াচ্ছে। তারা দাবি করছে নাচ-গান পাপ, অথচ এর কোনো সরাসরি ভিত্তি নেই।

👉 তাদের লক্ষ্য আসলে ধর্মের নামে সমাজকে বিভ্রান্ত করা, যাতে যুক্তিবাদী চিন্তা ও শিল্পচর্চা বন্ধ হয়ে যায়।

৪. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলো সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চায় মূলত রাজনৈতিক কারণে। সাংস্কৃতিক আয়োজন মানেই মানুষের সমাবেশ, একত্রিত হওয়া, সচেতনতা তৈরি। এতে মানুষ একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়, চিন্তা-ভাবনা ভাগাভাগি করে।

👉 এটি উগ্র গোষ্ঠীর জন্য হুমকি, কারণ সাংস্কৃতিক চেতনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, আর ঐক্যবদ্ধ মানুষ উগ্রবাদকে প্রতিহত করতে পারে। তাই তারা নাচ-গানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আসলে মানুষের মিলনমেলা ও সমবেত চেতনা ভাঙতে চায়।

৫. স্থানীয় সমাজে প্রভাব

কায়াতখালির মতো গ্রামে যদি নাচ-গানের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়—

তরুণ প্রজন্ম সৃজনশীলতা ও আনন্দের স্বাস্থ্যকর পথ হারাবে।

নারী শিল্পীরা তাদের প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ হারাবে।

গ্রামীণ ঐতিহ্য যেমন যাত্রা, পালাগান, লোকসংগীত—সবই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।

উগ্র গোষ্ঠীর প্রভাব বাড়বে, কারণ তারা সংস্কৃতির শূন্যতা ব্যবহার করে ভয় ও বিভ্রান্তি ছড়াবে।

৬. সংস্কৃতি বনাম উগ্রবাদ : ভবিষ্যতের লড়াই

নাচ-গান ও সংস্কৃতি শুধু বিনোদন নয়, এটি উগ্রবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অস্ত্র। যখন মানুষ গান গায়, নাটক মঞ্চায়ন করে, কবিতা পড়ে—তখন তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রকাশ করে। এই স্বাধীনতাই উগ্রবাদীদের সবচেয়ে বড় ভয়। তাই তারা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চায়।

উপসংহার

কায়াতখালিতে নাচ-গানের বিরুদ্ধে আপত্তি কোনো ধর্মীয় সত্য নয়; এটি উগ্রবাদী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক কৌশল। এর মাধ্যমে তারা নারীর স্বাধীনতাকে খর্ব করতে, মানুষের আনন্দকে স্তব্ধ করতে এবং সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়।

বাংলার সংস্কৃতি কখনো ধর্মের শত্রু ছিল না; বরং এটি মিলনমেলা, মানবিকতা ও ঐক্যের প্রতীক। তাই নাচ-গান রক্ষা মানে শুধু শিল্প রক্ষা নয়—এটি মুক্তচিন্তা, মানবিক সমাজ ও উগ্রবাদমুক্ত ভবিষ্যৎ রক্ষার সংগ্রাম।