বাংলাদেশে সময় সময় কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছ থেকে অদ্ভুত সব ফতোয়া ও দাবি শোনা যায়। কখনো তারা নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, কখনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ের বৈধতা খোঁজে, আবার কখনো চার বিয়ে বাধ্যতামূলক করার মতো অযৌক্তিক মতও প্রচার করে। প্রশ্ন হলো—এসব গোষ্ঠী আসলে কী চায়? তারা কেন এমন ফতোয়া দেয়?
—
১. ধর্ম নয়, রাজনৈতিক এজেন্ডা
ধর্ম মানুষের আত্মিক শান্তি ও নৈতিক উন্নতির জন্য। কিন্তু উগ্র গোষ্ঠীগুলো ধর্মকে ব্যবহার করছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। তাদের লক্ষ্য হলো—আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে এমন এক সমাজ গড়া, যেখানে মানুষের প্রতিটি সিদ্ধান্ত তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। “চার বিয়ে বাধ্যতামূলক” করার মতো ফতোয়া আসলে এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কৌশল।
—
২. ইসলামের মূল বক্তব্যের বিকৃতি
ইসলামে বহুবিবাহ অনুমোদিত হলেও কখনো বাধ্যতামূলক করা হয়নি। বরং কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে—যদি ন্যায়বিচার করতে না পারো তবে একটিতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। অর্থাৎ শর্ত হলো ন্যায়, সমতা ও দায়িত্ব। কিন্তু উগ্র গোষ্ঠীগুলো এই শর্তগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে কেবলমাত্র পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য ৪ বিয়ে বাধ্যতামূলক করার প্রচার চালায়।
—
৩. নারীর স্বাধীনতার ওপর আঘাত
এই দাবির পেছনে সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো নারীদের অধিকার সীমিত করা। নারী যেন শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা সামাজিক নেতৃত্বে ভূমিকা রাখতে না পারে, সেজন্যই তাদের জীবনের কেন্দ্রকে কেবল গৃহ ও পুরুষের অধীনে সীমাবদ্ধ করতে চায়। চার বিয়ে বাধ্যতামূলক হলে নারীকে একদিকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখা হবে, অন্যদিকে তার সামাজিক মর্যাদা কমে যাবে।
—
৪. সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
চার বিয়ে বাধ্যতামূলক হলে সমাজে কী ঘটবে?
পারিবারিক অস্থিরতা বাড়বে। একাধিক সংসার সামলানো অধিকাংশ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
নারীর মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়বে। তাকে প্রতিযোগিতার মধ্যে বেঁচে থাকতে হবে, যা অবমাননার জন্ম দেবে।
অর্থনৈতিক চাপ বাড়বে। চারটি পরিবার সামলানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা অধিকাংশ পুরুষের নেই। ফলে দারিদ্র্য ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব বাড়বে।
শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কমবে, যা সরাসরি দেশের উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
—
৫. কেন তারা এটা চায়?
সমাজকে বিভ্রান্ত করতে : তারা জানে এসব দাবি বিতর্ক তৈরি করবে, মানুষকে বিভ্রান্ত করবে, আর সেই সুযোগে তারা আলোচনায় টিকে থাকবে।
পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে : নারী যদি শিক্ষিত ও স্বাধীন হয়, তবে উগ্র মতাদর্শ টিকবে না। তাই নারীর স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করাই তাদের মূল লক্ষ্য।
রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করতে : আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত। সেটিকে ভেঙে ফেলতে চাইলে নারীকে সীমাবদ্ধ করা অপরিহার্য—এই ভাবনা থেকেই তারা এসব ফতোয়া দেয়।
—
উপসংহার
“চার বিয়ে বাধ্যতামূলক” করার প্রচেষ্টা কোনো ধর্মীয় সত্য নয়, বরং উগ্রবাদী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে তারা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াতে, নারীর অধিকার খর্ব করতে এবং পুরুষতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা এবং আধুনিকতার অগ্রগতি রক্ষার জন্য এই ধরনের দাবির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া জরুরি।
একটি কথা মনে রাখা দরকার—ধর্ম মানুষকে মুক্তি দেয়, মানবিক করে; আর যারা ধর্মের নামে অমানবিক ও অবাস্তব দাবি চাপিয়ে দেয়, তারা আসলে ধর্মের শত্রু, সমাজের শত্রু এবং ভবিষ্যতের শত্রু।