Thu. Sep 11th, 2025

মুন্সীগঞ্জের কায়াতখালি গ্রামে হিজবুত তাহরির কর্তৃক জারি করা ফতোয়া—যেখানে বলা হয়েছে ১০ বছরের মেয়েকেও বিয়ে দেওয়া যায়—শুধু একটি স্থানীয় ঘটনা নয়; এটি বাংলাদেশ সমাজকে পিছনে টেনে ধরার একটি ভয়ংকর ইঙ্গিত। এই ফতোয়া আইন, ধর্ম, মানবাধিকার ও জাতীয় উন্নয়ন—সবকিছুর পরিপন্থী। বিষয়টিকে তাই কেবল ধর্মীয় বিভ্রান্তি হিসেবে দেখা যাবে না; এর গভীরে আছে একধরনের কৌশলগত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।

১. শিশু বিবাহ : বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক বাস্তবতা

অপ্রাপ্তবয়স্ক বয়সে বিয়ে মানে মেয়েদের স্বাভাবিক শারীরিক বিকাশে হস্তক্ষেপ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণা বলছে, অল্প বয়সে গর্ভধারণের ফলে মাতৃমৃত্যুর হার কয়েকগুণ বেড়ে যায়, একইসঙ্গে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি থাকে। শারীরিক স্বাস্থ্য ছাড়াও মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছোট্ট বয়সে দায়িত্ব ও পারিবারিক চাপ একদিকে শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে, অন্যদিকে ব্যক্তিত্বকে অসম্পূর্ণ অবস্থায় আটকে দেয়। ফলে এই ফতোয়া শুধু অমানবিক নয়, বিজ্ঞান ও বাস্তবতার সম্পূর্ণ অস্বীকার।

২. ধর্মের অপব্যাখ্যা

ইসলামের মূল শিক্ষা হলো কল্যাণ, ন্যায়বিচার ও মানবমর্যাদা। ইসলামিক ইতিহাসে বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স, সক্ষমতা ও সম্মতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হিজবুত তাহরিরের মতো উগ্র গোষ্ঠী ধর্মকে বিকৃত করে নিজেদের মতাদর্শ চাপিয়ে দেয়। তারা ধর্মীয় পরিভাষা ব্যবহার করে আসলে সমাজকে অন্ধ আনুগত্যে বাধ্য করতে চায়। এর মাধ্যমে তারা মানুষকে যুক্তিহীন ও ভীতিপ্রবণ করে রাখে—যা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের অন্যতম হাতিয়ার।

৩. জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনীতির সাথে সম্পর্ক

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে উত্তরণের পথে। এই যাত্রায় নারীর অবদান অপরিসীম। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে আসছে বলেই জাতীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে। যদি শিশুকালেই মেয়েদের বিয়ের শৃঙ্খলে বেঁধে দেওয়া হয়, তবে তারা শিক্ষার সুযোগ হারাবে, অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। অর্থাৎ নারীশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র সীমিত হলে পুরো জাতিই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়বে।

৪. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ

হিজবুত তাহরিরের মতো গোষ্ঠীগুলো জানে—একজন শিক্ষিত নারী সচেতন হয়, প্রশ্ন করতে শেখে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে। তাই তারা নারীদের অশিক্ষিত, অধিকারহীন এবং কম বয়সেই পারিবারিক দায়িত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়। এটি আসলে সমাজকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল, যেখানে অশিক্ষা ও অন্ধ আনুগত্যই তাদের শক্তির উৎস।

৫. রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা : শিশু বিবাহ প্রতিরোধ আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। যারা এ ধরনের ফতোয়া জারি বা প্রচার করে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

সামাজিক দায়িত্ব : অভিভাবক, শিক্ষক, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ—সবার দায়িত্ব মেয়েদের শিক্ষার পথ উন্মুক্ত রাখা এবং এ ধরনের উগ্রতার বিরুদ্ধে একসাথে দাঁড়ানো।

শিক্ষা ও সচেতনতা : কায়াতখালীর মতো গ্রামে সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সম্ভব নয়। শিশু বিবাহের ক্ষতি ও আইন ভঙ্গের শাস্তি সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে।

উপসংহার

কায়াতখালিতে ১০ বছরের শিশুর বিয়ের ফতোয়া একটি সতর্ক সংকেত। এটি শুধু একটি গ্রামের সমস্যা নয়, পুরো সমাজকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র। এ ধরনের উগ্রপন্থা যদি প্রতিরোধ করা না যায়, তবে তা বাংলাদেশের উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় বিপর্যয় বয়ে আনবে। তাই আজই প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ, ধারাবাহিক সচেতনতা এবং সবচেয়ে বড় কথা—শিশুর অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার দৃঢ় সামাজিক প্রতিজ্ঞা।