Thu. Sep 11th, 2025

মুন্সীগঞ্জের কায়াতখালী গ্রাম। পদ্মার চর পেরিয়ে যে গ্রামে মানুষ ভোরে মাঠে যায়, দুপুরে হাটে যায়, আর সন্ধ্যায় বসে আড্ডা মারে। যেখানে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, যেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই ঢাক-ঢোলের তালে নাচ-গান, যেখানে বৈশাখে মেলায় ভিড় জমে। সেই গ্রামেই আজ হিজবুত তাহরিরের মৌলবাদীরা গেড়ে বসেছে।

তারা দাবি করছে—

মেয়েরা নাকি বেশি পড়াশোনা করতে পারবে না,

পুরুষদের নাকি চার বিয়ে করতেই হবে,

গান, বাজনা, নাটক, মেলা সব বন্ধ করতে হবে।

এ যেন মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরেও আমাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার চেষ্টা।

মেয়েদের শিক্ষার পথে বাঁধা: ভবিষ্যৎ বন্ধ করার ষড়যন্ত্র

কায়াতখালীর স্কুলে আজ অনেক মেয়ে পড়াশোনা করছে। কেউ হতে চায় ডাক্তার, কেউ শিক্ষক, কেউ পুলিশ অফিসার। বাবা-মায়েরা খুশি হয়ে মেয়েদের পড়াশোনায় টাকা খরচ করছেন। অথচ মৌলবাদীরা ঘুরে ঘুরে বলছে—মেয়েদের এত পড়াশোনার দরকার নেই, প্রাইমারি শেষ হলেই থামিয়ে দিতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো—যদি মেয়েরা না পড়ে, তবে আগামী প্রজন্মকে শিক্ষা দেবে কে? একজন অশিক্ষিত মা কি তার সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে? তাই আসলে এই ফতোয়ার মানে হলো পুরো গ্রামকে অশিক্ষিত রেখে দেওয়া।

চার বিয়ে বাধ্যতামূলক: সমাজে অশান্তি ছড়ানোর ফাঁদ

গ্রামে আমরা দেখি, একজন মানুষ সংসার চালাতে গিয়ে কত কষ্ট করেন। সন্তানদের পড়াশোনা, চিকিৎসা, বিয়েশাদি—একটা সংসারই অনেক বড় দায়িত্ব। সেখানে চার বিয়ে বাধ্যতামূলক করার কথা বলাটা কেবলই অবাস্তব নয়, ভয়ংকর। এটা সমাজে নতুন করে দ্বন্দ্ব, অশান্তি আর নারীর ওপর নির্যাতন বাড়াবে।

ধর্মকে বিকৃত করে যারা এই দাবি তুলছে, তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট—নারীকে আবার ঘরে বন্দি রাখা, তাকে পণ্য বানানো।

গান-বাজনা বন্ধ মানে গ্রামের প্রাণ শুকিয়ে দেওয়া

কায়াতখালীর মানুষ আনন্দপ্রিয়। বিয়ের অনুষ্ঠান হলে মাইকে গান বাজে, বৈশাখে মেলায় বাউলরা গান গায়, শীতকালে যাত্রাপালা বসে। এগুলো ছাড়া গ্রাম মানেই ফাঁকা খোলস।

কিন্তু মৌলবাদীরা বলছে এগুলো নাকি হারাম। তারা আসলে আমাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা কেড়ে নিতে চাইছে। অথচ মনে রাখতে হবে—সংস্কৃতি হলো জীবনের রঙ। গান-বাজনা বন্ধ মানে মানুষের হৃদয় শুকিয়ে দেওয়া।

মৌলবাদীরা আসলে কী চায়?

তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার:

মানুষকে ভয় দেখানো,

অজ্ঞতা বাড়ানো,

সমাজকে পেছনে টেনে রাখা।

তারা জানে, শিক্ষিত মানুষ প্রশ্ন করে। শিক্ষিত নারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সাংস্কৃতিক মানুষ মুক্তমনা হয়। তাই এরা সবকিছু বন্ধ করে দিতে চায়।

গ্রামের মানুষের করণীয়

এখন প্রশ্ন—আমরা কী করব?

১. গ্রামের শিক্ষকরা খোলাখুলি বলতে হবে—মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ করা যাবে না।

২. ইমাম ও আলেমরা সত্যিকারের ইসলাম প্রচার করবেন—যেখানে জ্ঞান অর্জনকে বাধ্যতামূলক বলা হয়েছে।

৩. স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রশাসনের সহায়তায় এ ধরনের উগ্রবাদী কার্যকলাপ দমন করবেন।

৪. তরুণ প্রজন্ম গ্রামে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আরও জোরদার করবে—নাটক, গান, কবিতা, খেলাধুলা।

৫. মহিলারা সংগঠিত হয়ে তাদের শিক্ষার অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হবেন।

উপসংহার

কায়াতখালীর মৌলবাদীরা চায় গ্রামকে আবার অন্ধকারে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে নারীর শিক্ষা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা আর ব্যক্তিগত অধিকার নিয়ে কোনো আপস নেই।

আমাদের স্পষ্ট ঘোষণা—

এই মাটিতে মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হবে না।

এই মাটিতে নারীকে চার দেয়ালে বন্দি করা হবে না।

এই মাটিতে গান বাজনা, আনন্দ-উৎসব থামবে না।

কায়াতখালী গ্রাম অন্ধকারে নয়, আলোর পথেই হাঁটবে। আর মৌলবাদীদের জায়গা হবে শুধু ইতিহাসের আবর্জনার স্তূপে।