মুন্সীগঞ্জের কায়াতখালিতে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে কিছু ধর্মান্ধ গোষ্ঠী নাচ-গানকে “অশ্লীলতা” বা “পাপ” আখ্যা দিয়ে সমাজে প্রচার চালাচ্ছে। তারা দাবি করছে, এ ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ধর্মবিরোধী। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আসলে তাদের আপত্তির পেছনে কী কারণ?
—
১. সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান মানেই চিন্তার বিরুদ্ধে অবস্থান
নাচ-গান মানুষের স্বাভাবিক আনন্দ ও সামাজিক বন্ধনের অন্যতম মাধ্যম। এগুলো প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার সংস্কৃতির অংশ। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলো এটিকে শুধু বিনোদন হিসেবে দেখে না; তারা বোঝে, সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই মানুষ মুক্ত চিন্তা, আনন্দ ও সৃজনশীলতা চর্চা করে। আর সৃজনশীল মানুষ কখনো অন্ধ আনুগত্যে বাধ্য হয় না। তাই তারা সংস্কৃতিকে বন্ধ করতে চায়।
—
২. নারীর অংশগ্রহণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা
নাচ-গান মানেই সেখানে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী নারীর কণ্ঠ, দেহভঙ্গি বা শিল্পচর্চাকে দমন করতে চায়। তারা মনে করে নারীর প্রকাশ ও স্বাধীনতা যত সীমিত করা যাবে, সমাজকে তত সহজে পুরুষতান্ত্রিক শাসনে রাখা সম্ভব হবে। ফলে নাচ-গানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসলে নারীর প্রকাশ ও স্বাধীনতাকে থামানোর একটি কৌশল।
—
৩. ধর্মীয় ব্যাখ্যার অপপ্রয়োগ
কোরআন বা হাদিসে কোথাও নাচ-গানকে সরাসরি হারাম বলা হয়নি। বরং ইসলামি সভ্যতায় সঙ্গীত, কবিতা, নাটক ও সাহিত্য ছিল সমৃদ্ধ। মুসলিম দার্শনিক আল-ফারাবি, ইবনে সিনা, এমনকি সুফি সাধকেরাও সংগীতকে আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যম হিসেবে দেখেছেন। অথচ কায়াতখালির ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে ভীত করে তুলতে চাইছে।
—
৪. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
নাচ-গানের বিরুদ্ধে অবস্থান কেবল ধর্মীয় নয়, বরং রাজনৈতিকও। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানেই মানুষের মিলনমেলা, সমবেত চেতনা, সচেতনতা সৃষ্টি। এটি উগ্র গোষ্ঠীর জন্য হুমকি, কারণ একত্রিত মানুষ সংস্কৃতির শক্তিতে উগ্রবাদ প্রতিহত করতে পারে। তাই তারা সংস্কৃতি ধ্বংস করে বিভাজন ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়।
—
৫. স্থানীয় সমাজে প্রভাব
কায়াতখালির মতো গ্রামে যদি নাচ-গানের আয়োজন বন্ধ হয়ে যায়—
তরুণ প্রজন্ম আনন্দ ও সৃজনশীলতার সুযোগ হারাবে।
নারী শিল্পীরা নিজেদের প্রতিভা প্রকাশের পথ হারাবে।
গ্রামীণ ঐতিহ্য ধ্বংস হবে।
উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রভাব বাড়বে।
—
উপসংহার
কায়াতখালিতে নাচ-গানের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ আপত্তি আসলে সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে তারা সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়, নারীর স্বাধীনতাকে দমন করতে চায় এবং রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
বাংলার সংস্কৃতি কখনো ধর্মের শত্রু নয়; বরং এটি মানবিকতা, মিলনমেলা ও ঐক্যের প্রতীক। তাই নাচ-গান রক্ষা মানে কেবল শিল্প রক্ষা নয়—এটি উগ্রবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, সমাজকে আলোকিত করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্ত চিন্তার পথে এগিয়ে নেওয়া।